স্ত্রীর পরকীয়ার বলি স্বামী ও মেয়ে!

রাজধানীর বাড্ডায় জোড়া খুনের নেপথ্যে ছিল আরজিনা আর শাহিনের পরকীয়ার সম্পর্ক। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কারণে নৃসংশ খুনের শিকার হন আরজিনার স্বামী জামিল শেখ ও তার মেয়ে নুসরাত জাহান। আরজিনা, প্রেমিক শাহীন এবং শাহীনের স্ত্রী মাসুমাÑ এই তিনজন মিলে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে ঘুমন্ত জামিল শেখকে। ঘটনার সময় জামিল শেখ প্রাণ বাঁচাতে অনুনয় বিনয় করলেও ঘাতকদের মন গলেনি। তার চিৎকারে ঘুম থেকে জেগে ওঠে ৯ বছরের শিশুসন্তান নুসরাত জাহান। তার মায়ের হাতে রক্তমাখা বঁটি দেখে ভিষণ ভয় পায় সে। পাশেই দাঁড়ানো কাঠের টুকরা হাতে দাঁড়িয়ে শাহীন। ‘আংকেল, আমার বাবাকে মারছেন কেন?’ শাহীনের উদ্দেশে এমন প্রশ্ন করেই বিছানায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত বাবার নিথর দেহ জড়িয়ে ধরে শিশু নুসরাত। পরকীয়ায় মত্ত আরজিনা নিজের শিশুসন্তানকেও রেহাই দেননি। তিনি নিজেই নুসরাতের দুপা চেপে ধরে শাহীনকে বললেন, ‘এটাকেও শেষ করে দাও’। এ কথা শুনেই শাহিন গলা টিপে হত্যা করে নুসরাতকে।

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে আরজিনা স্বীকার করেছেন তার পরকীয়ার আদ্যপান্ত। দিয়েছেন সেই রাতে স্বামী-সন্তান খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা। আরজিনার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ খুলনা থেকে গ্রেপ্তার করেছে প্রেমিক শাহীন এবং তার স্ত্রী মাসুমাকে। তিনজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনজনই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করতে শুরু করেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ জানায়, আরজিনা এবং শাহীনের টার্গেট ছিল জামিল শেখ। কিন্তু হত্যাকা- দেখে ফেলায় শিশু নুসরাতকে তারা খুন করে। আর এসব পরিকল্পনা করে আরজিনা ও শাহীন। শাহীনের পুরো নাম শাহীন মল্লিক। বয়স ২৬। পেশায় রং মিস্ত্রী। তার স্ত্রী মাসুমা বিভিন্ন বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন। বাড্ডায় আগে যে বাসায় আরজিনারা থাকতেন, সেখান থেকেই শাহীনের সঙ্গে পরিচয়। ছয় মাসের এই পরিচয়ের মধ্যেই তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। জড়িয়ে পড়েন পরকীয়ায়। এসব তথ্য আরজিনা পুলিশের কাছে জানিয়েছে। পুলিশ জানায়, গতকাল ভোরে খুলনা থেকে শাহীন ও মাসুমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জুমার নামাজের পর পরই তাদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার জামিলের ভাই শামীম শেখ বাড্ডা থানায় আরজিনা ও শাহীনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাখাওয়াত হোসেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বাড্ডা জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার আশরাফুল কবির জানান, জিজ্ঞাসাবাদে আরজিনার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শাহীন ও তার স্ত্রী মাসুমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আগে তারা যে বাসার দ্বিতীয় তলায় ভাড়া থাকতেন, সেখানে তৃতীয় তলায় থাকতেন শাহীনরা। তখনই তাদের মধ্যে প্রেম হয়। আর বাসা বদলের সময় আরজিনাই কৌশলে শাহীনদের সাবলেটে নিয়ে আসে। গত মাসে বাড্ডার হোসেন মার্কেটের পেছনে ময়নারবাগে ৩০৬ নম্বর পাঠানবাড়িতে সপরিবারে বাসা ভাড়া নেন জামিল শেখ। আগে তিনি আরও তিন বাড়ির পূর্বদিকে ভাড়া ছিলেন। তখন থেকেই শাহীনের সঙ্গে সখ্য বাড়ে আরজিনার। এরপর অল্পদিনেই দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে অনৈতিক সম্পর্ক। মোবাইলফোনে এই ভিডিও ধারণ করে রাখেন শাহীন। ওই ভিডিওর ভয় দেখিয়ে প্রতিনিয়ত আরজিনার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক চলতে থাকে। এক পর্যায়ে শাহীনের সঙ্গে গভীর প্রেমে পড়ে যান আরজিনাও। চলতি বছরের জুনের দিকে বেড়ানোর কথা বলে ৫ বছরের ছেলে আলভীকে নিয়ে বাবা-মায়ের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের বলকৈতে চলে যান তিনি। এ সময় বাবা জামিলের কাছেই ছিল নুসরাত। জামিলের ভগ্নিপতি মহসিন জানান, আরজিনা বাবার বাড়ি যাওয়ার সময় তার সব জিনিসপত্র নিয়ে যান। তখন জামিল তাকে বলেনÑ ‘কেউ বাপের বাড়ি বেড়াতে গেলে এতকিছু কি নিয়ে যায়?’ উত্তরে তিনি জামিলকে বলেছিলেন ‘বেড়াতে গেলে মেয়ে মানুষের একটু বেশি কাপড়-চোপড় নিতে হয়।’ আরজিনা বাবার বাড়িতে থাকার কয়েকদিন পর জামিলের সংসার করবেন না বলে জানান। কিছুদিন পর গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকার সাভারে মায়ের কাছে চলে আসেন তিনি। এখানে থাকাবস্থায় শাহীনের সঙ্গে তার একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক হয়। মাস দুয়েক আগে মহসিনের মধ্যস্থতায় জামিলের কাছে ফেরেন আরজিনা। পাঠানবাড়ির তৃতীয় তলায় দুই রুমের নতুন ভাড়া বাসার তার কথা অনুযায়ী শাহীনকে সাবলেট দেন জামিল। এর কয়েকদিনের মধ্যে আরজিনা-শাহীনের পরকীয়ার বিষয়টি টের পান মাসুমা। কিন্তু আরজিনাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না বলে মাসুমাকে সাফ জানিয়ে দেন শাহীন। সব মেনে নিয়ে শাহীনের সঙ্গে সংসার করতে রাজি হন মাসুমা। তবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আরজিনার এ তথ্যটিতে অসঙ্গতি পান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পেশায় গাড়িচালক ছিলেন জামিল। সকালে মেয়ে সুসরাতকে বাড্ডা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে দিয়ে গুলশানে এক ব্যক্তির গাড়ি চালাতে চলে যেতেন তিনি। একই সময়ে শাহীনের স্ত্রী মাসুমাও অন্যের বাসাবাড়িতে রান্নার কাজ করতে যেতেন। এ সুযোগে আরজিনা আর শাহীন অবৈধ মেলামেশা করতেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরজিনা আরও জানিয়েছেন, তিনি ও শাহীন আরও কাছাকাছি হওয়ার জন্যই জামিলকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সব আচরণই স্বাভাবিক রাখেন আরজিনা। বুধবার রাত ১১টার দিকে শুয়ে পড়ার আগে ঘরের থাই-অ্যালুমিনিয়ামের সব জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর নিজেদের ঘরের লোহার দরজা খুলে রেখে জামিলের পাশে ঘুমাতে যান আরজিনা। তখন রাত সাড়ে ১২টা। কাঁথা মুড়িয়ে গভীর ঘুমে জামিল। সেগুনের এক টুকরো কাঠ শাহীনের হাতে। আর বঁটি ছিল মাসুমার কাছে। চুপিসারে বিছানার কাছাকাছি তারা দুজন। খুব আস্তে জামিলের পা চেপে ধরেন আরজিনা। শুরু হয় জামিলের মাথায় শাহীন-মাসুমার একের পর এক কোপ ও লাঠির আঘাত। উপর্যুপরি কোপের আঘাতে জেগে ওঠে জামিল বলেছিলেন ‘ভাই আমাকে মারছেন কেন?’ তবুও মাথার ওপর চলছিল কোপ। আপ্রাণ বাঁচার চেষ্টা করেও একপর্যায়ে নীরব, নিথর হয়ে যান জামিল। বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী জানান, মূলত ঘটনার সাক্ষী না রাখার জন্যই তারা নুসরাতকে মেরে ফেলেছিল। কাকরাইলে মা-ছেলে খুনের ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পরই বাড্ডা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে বাবা-মেয়ে খুনের খবর। এরপর সেখানে আশপাশের উৎসুক মানুষের ভিড় জমে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল ঘিরে রাখে র্যাব-পুলিশের সদস্যরা। বাবা জামিল শেখ (৩৫) ও তার মেয়ে নুসরাত জাহানের (৯) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয় জামিল শেখের স্ত্রী আরজিনাকে (২৫)।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment